তৈলচিত্রের ভূত -মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ৮ম শ্রেণি

তৈলচিত্রের ভূত
ekram145
UX/UI Designer at - Adobe

Sharing is caring!

তৈলচিত্রের ভূত’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি কিশাের উপযােগী ছােটগল্প। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘মৌচাক’ পত্রিকায় এ গল্পটি প্রকাশিত হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘তৈলচিত্রের ভূত’ ছােটগল্পটি অতিপ্রাকৃত ঘটনার আশ্রয়ে রচনা করেছেন। এটি কিশাের উপযােগী রচনাসমুহের অন্তর্ভূক্ত একটি ছােটগল্প। সমাজে ভূত প্রেতে বিশ্বাস নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার যে ভিত্তিহীন সেই বিষয়টি এ গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।  নিচে থেকে তৈলচিত্রের ভূত গল্প  টি পড়ুন। এখানে সম্পূর্ণ গল্পও, মূলভাব ও ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।

তৈলচিত্রের ভূত

একদিন সকাল বেলা পরাশর ডাক্তার  নিজের প্রকান্ড লাইব্রেরিতে বসে চিঠি লিখছিলেন। চোরের মতো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে নগেন ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে তার টেবিল ঘেঁষে দাঁড়াল। পরাশর ডাক্তার মুখ না তুলেই বললেন, বোসো, নগেন।চিঠিখানা শেষ করে খামে ভরে ঠিকানা লিখে সেটি ডাকে পাঠিয়ে দিয়ে তবে আবার নগেনের দিকে তাকালেন।

বসতে বললাম যে? এ রকম চেহারা হয়েছে কেন? অসুখ নাকি?

নগেন ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। চোরকে যেন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সে চুরি করে কিনা, এই রকম অতিমাত্রায় বিব্রত হয়ে সে বলল, না না, অসুখ নয়, অসুখ আবার কিসের।

গুরুতর কিছু ঘটেছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে পরাশর ডাক্তার দুহাতের আঙুলের ডগাগুলি একত্র করে নগেনকে দেখতে লাগলেন। মোটাসোটা হাসিখুশি ছেলেটার তেল চকচকে চামড়া পর্যন্ত যেন শুকিয়ে গেছে, মুখে হাসির চিহ্নটুকুও নেই। চাউনি একটু উদভ্রান্ত। কথা বলার ভঙ্গি পর্যন্ত কেমন খাপছাড়া হয়ে গেছে।

নগেন তার মামাবাড়িতে থেকে কলেজে পড়ে। মাস দুই আগে নগেনের মামার শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়ে পরাশর ডাক্তার নগেনকে দেখেছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে এমন কী ঘটেছে যাতে ছেলেটা এরকম বদলে যেতে পারে? ছেলেবেলা থেকে মামাবাড়িতেই সে মানুষ হয়েছে বটে কিন্তু মামার শোকে এরকম কাহিল হয়ে পড়ার মতো আকর্ষণ তো মামার জন্য তার কোনদিন ছিল না। বড়লোক কৃপণ মামার যে ধরনের আদর বেচারি চিরকাল পেয়ে এসেছে তাতে মামার পরলোক যাত্রায় তার খুব বেশি দুঃখ হবার কথা নয়। বাইরে মামাকে খুব শ্রদ্ধাভক্তি দেখালেও মনে মনে নগেন যে তাকে

প্রায়ই যমের বাড়ি পাঠাত তাও পরাশর ডাক্তার ভালো করেই জানতেন। পড়ার খরচের জন্য দুশ্চিন্তা হওয়ার কারণও নগেনের নেই, কারণ শেষ সময়ে কী ভেবে তার মামা তার নামে মোটা টাকা উইল করে রেখে গেছেন।

(২১)

নগেন হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘ডাক্তার’ কাকা, সত্যি করে একটা কথা বলবেন? আমি কী পাগল হয়ে গেছি’? পরাশর ডাক্তার একটু হেসে বললেন, ‘তোমার মাথা হয়ে গেছ’। পাগল হওয়া কী মুখের কথা রে বাবা! পাগল যে হয় অত সহজে সে টের পায় না সে পাগল হয়ে গেছে’।

‘তবে’- দ্বিধা ভরে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ নগেন যেন মরিয়া হয়ে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘আচ্ছা ডাক্তার কাকা, প্রেতাত্মা আছে’?

প্রেতাত্মা মানে তো ভূত? নেই’।

নেই? তবে-

অনেকক্ষণ ইতস্তত করে, অনেক ভূমিকা করে, অনেকবার শিউরে উঠে নগেন ধীরে ধীরে আসল ব্যাপারটা খুলে বলল। চমকপ্রদ অবিশ্বাস্য কাহিনী। বিশ্বাস করা শক্ত হলেও পরাশর ডাক্তার বিশ্বাস করলেন। মিথ্যা গল্প বানিয়ে তাকে শোনাবার ছেলে যে নগেন নয়, তিনি তা জানতেন।

মামা তাকেও প্রায় নিজের ছেলেদের সমান টাকাকড়ি দিয়ে গেছেন জেনে প্রথমটা নগেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মামার এরকম উদারতা সে কোনো দিন কল্পনাও করতে পারে নি। বাইরে যেমন ব্যবহারই করে থাকুন, মামা তাকে নিজের ছেলেদের মতোই ভালোবাসতেন জেনে পরলোকগত মামার জন্য আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তিতে তার মন ভরে গেল। আর সেই সঙ্গে জাগল এরকম দেবতার মতো মানুষকে সারাজীবন ভক্তি ভালোবাসার ভান করে ঠকিয়েছে ভেবে দারুন লজ্জা আর অনুতাপ। শ্রাদ্ধের দিন অনেক রাত্রে বিছানায় শুতে যাওয়ার পর অনুতাপটা যেন বেড়ে গেল- শুয়ে শুয়ে সে

ছটফট করতে লাগল। হঠাৎ এক সময় তার মনে হলো, সারা জীবন তো ভক্তিশ্রদ্ধার ভান করে মামাকে সে ঠকিয়েছে, এখন যদি সত্য সত্যই ভক্তিশ্রদ্ধা জেগে থাকে লাইব্রেরি ঘরে মামার তৈলচিত্রের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে এলে হয়তো আত্মগ্লানি একটু কমবে, মনটা শান্ত হবে।

রাত্রি তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে, সকলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে, বাড়ি অন্ধকার। এত রাত্রে ঘুমানোর বদলে মামার তৈলচিত্রের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়াটা যে রীতিমতো খাপছাড়া ব্যাপার হবে সে জ্ঞান নগেনের ছিল। তাই কাজটা সকালের জন্য স্থগিত রেখে সে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু তখন তার মাথা গরম হয়ে গেছে। মন একটু শান্ত না হলে যে ঘুম আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই, কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর সেটা ভালো করেই টের পেয়ে শেষকালে মরিয়া হয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল।

লাইব্রেরিটি নগেনের দাদামশায়ের আমলের। লাইব্রেরি সম্পর্কে নগেনের মামার বিশেষ কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। তার আমলে গত ত্রিশ বছরের মধ্যে লাইব্রেরিটি পিছনে একটি পয়সাও খরচ করা হয়েছে কিনা সন্দেহ। আলমারি কয়েকটি অল্প দামি আর অনেক দিনের পুরোনো, ভিতরগুলি বেশিরভাগ অদরকারি বাজে বইয়ে ঠাসা এবং উটরে বহুকালের ছেড়া মাসিকপত্র আর নানা রকম ভাঙাচোরা ঘরোয়া জিনিস গাদা করা। টেবিলটি এবং চেয়ার কয়েকটি খুব সম্ভব অন্য ঘর থেকে পেনশন পেয়ে এ ঘরে স্থান পেয়েছে। দেয়ালে তিনটি বড় বড় তৈলচিত্র, সস্তা ফ্রেমে বাধানো কয়েকটা সাধারণ রঙিন ছবি ও ফটো টাঙানো। তা ছাড়া কয়েকটা পুরনো ক্যালেন্ডারের ছবিও আছে-কোনোটাতে ডিসেম্বর, কোনোটাতে চৈত্রমাসের বারো তারিখ লেখা কাগজের ফলক এখনো ঝুলছে।

তৈলচিত্রের একটি নগেনের দাদামশায়ের, একটি দিদিমার এবং অপরটি তার মামার। দাদামশায় আর দিদিমার তৈলচিত্র দুটি একদিকের দেয়ালে পাশাপাশি টাঙানো আছে, মামার তৈলচিত্রটি স্থান জুড়ে আছে পাশের দেয়ালের মাঝামাঝি।

কারো ঘুম ভেঙে যাবে ভয়ে নগেন আলো জ্বালেনি। কিন্তু তাতে তার কোনো অসুবিধা ছিল না, ছেলেবেলা থেকে এ বাড়ির আনাচ-কানাচের সঙ্গে তার পরিচয়। লাইব্রেরিতে ঢুকে অন্ধকারেই সে মামার তৈলচিত্রের কাছে এগিয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে আমায় ক্ষমা করো মামা বলে যেই সে তৈলচিত্রের পায়ের কাছে আন্দাজে স্পর্শ করেছে-বর্ণনার এখানে পৌঁছে নগেন শিউরে চুপ করে গেল। তার মুখ আরও বেশি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, দুচোখ বিস্ফোরিত।

‘তারপর’?

নগেন ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোট চেপে বলল, ‘যেই ছবি ছুয়েছি ডাক্তার কাকা, কে যেন আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল। সমস্ত শরীরটা ঝনঝন করে উঠল তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হতে দেখি, সকাল হয়ে গেছে, আমি মামার ছবির নিচে মেঝেতে পড়ে আছি’।

পরাশর ডাক্তার গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার আগে কোনোদিন ফিট হয়েছিল নগেন’?

নগেন মাথা নেড়ে বলল ফিট?-না, কস্মিনকালে ও আমার ফিট হয়নি। আপনি ভুল করেছেন ডাক্তার কাকা, এ ফিট নয়, মরলে তো মানুষ সব জানতে পারে, মামাও জানতে পেরেছেন টাকার লোভে আমি মিথ্যা ভক্তি দেখাতাম। তাই ছবি ছোঁয়ামাত্র রাগে ঘেন্নায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সবটা শুনুন আগে, তা হলে বুঝতে পারবেন।

সমস্ত সকালটা নগেন মড়ার মতো বিছানায় পড়ে রইল। এই চিমতাটাই কেবল তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল, ভক্তি ভালোবাসায় ছলনায় টাকা আদায় করে নিয়েছে বলে পরলোকে গিয়েও তার ওপর মামার এখন জোরালো বিতৃষ্ণা জেগেছে যে তার তৈলচিত্রটি পর্যমত তিনি তাকে স্পর্শ করতে দিতে রাজি নন। যাই হোক, নগেন একালের ছেলে, প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর তার মনে নানারকম দ্বিধা-সন্দেহ জাগতে লাগল। কে জানে রাত্রে যা ঘটেছে তা নিছক স্বপ্ন কিনা। ধৈর্য ধরতে না পেরে দুপুরবেলা সে আবার লাইব্রেরিতে গিয়ে মামার তৈলচিত্র স্পর্শ করে প্রণাম করল। একবার যদি মামা রাগ দেখিয়ে থাকেন, আবার দেখাবেন না কেন?

এবার কিছুই ঘটল না। শরীরটা অবশ্য খুব খারাপ হয়ে আছে, মেঝেতে ধাক্কা যেখানে লেগেছিল মাথার সেখানটা ফুলে টনটন করছে এবং সকালে লাইব্রেরিতে মামার তৈলচিত্রের নিচে মেঝেতেই তার জ্ঞান হয়েছিল। কিন্তু এতে বড়জোর প্রমাণ হয়, রাত্রে ঘুমের মধ্যেই হোক আর জাগ্রত অবস্থাতেই হোক লাইব্রেরিতে গিয়ে সে একটা আছাড় খেয়েছিল। নিজের তৈলচিত্রে ভর করে মামাই যে তাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন তার কী প্রমাণ আছে?

নগেন যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। কিন্তু বেশিক্ষণ তার মনের শামিত টিকল না। রাত্রে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়েই হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, তার তো ভুল হয়েছে। দিনের বেলা তাকে ধাক্কা দেয়ার ক্ষমতা তো তার মামার এখন নেই, রাত্রি ছাড়া তার মামা তো এখন কিছুই করতে পারেন না! কী সর্বনাশ! তবে তো রাত্রে আরেকবার মামার তৈলচিত্র না ছুয়ে কাল রাত্রের ব্যাপারকে স্বপ্ন বলা যায় না।

তৈলচিত্রের ভূত 

এত রাত্রে আবার লাইব্রেরিতে যাওয়ার কথা ভেবেই নগেনের হৃৎকম্প হতে লাগল। কিন্তু এমন একটা সন্দেহ না মিটিয়েই বা মানুষের চলে কী করে? খানিকটা পরে নগেন আবার লাইব্রেরিতে হাজির। ভয়ে বুক কাঁপছে, ছুটে পালাতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু কী এক অদম্য আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে চলেছে মামার তৈলচিত্রের দিকে। ঘরে ঢুকেই সে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। মটকার পাঞ্জাবির ওপর দামি শাল গায়ে মামা দেয়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় কাচাপাকা চুল, মুখে একজোড়া মোটা গোফ, চোখে ভৎর্সনার দৃষ্টি। নগেন এগিয়ে গিয়ে মামার পায়ের কাছে ছবি স্পর্শ করল। কেউ তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল না, কিন্তু সমস্ত শরীরটা হঠাৎ যেন কেমন অস্থির অস্থির করতে লাগল। তৈলচিত্র থেকে কী যেন তার মধ্যে প্রবেশ করে ভেতর থেকে তাকে কাপিয়ে তুলছে।

তবু নগেন যেন বাঁচল। ভয়ের জন্য শরীর এরকম অস্থির অস্থির করতে পারে। সেটা সামান্য ব্যাপার।

ফিরে যাওয়ার সময় আলোটা নিভিয়েই নগেন আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার আরেকটা কথা মনে এসেছে। কাল ঘর অন্ধকার ছিল, আজ আলোটা থাকার জন্য যদি মামা কিছু না করে থাকেন? নগেনের ভয় অনেকটা কমে গিয়েছিল, অনেকটা নিশ্চিমত মনেই সে অন্ধকারে তৈলচিত্রের কাছে ফিরে গেল। সে জানে অন্ধকারে তৈলচিত্র স্পর্শ করলেও কিছু হবে না। ঘরে একটা আলো জ্বলছে কি জ্বলছে না তাতে বিশেষ কী আসে যায়? ইতস্তত না করেই সে সোজা তৈলচিত্রের

দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। পরক্ষণে-

ঠিক প্রথম রাত্রের মতো জোরে ধাক্কা দিয়ে মামা আমায় ফেলে দিলেন ডাক্তার কাকা।

অজ্ঞান হয়ে গেলে?

না, একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাইনি। অবশ্য আচ্ছন্নের মতো অনেকক্ষণ মেঝেতে পড়ে ছিলাম, কিন্তু জ্ঞান ছিল। তারপর থেকে আমি ঠিক পাগলের মতো হয়ে গেছি ডাক্তার কাকা। দিনরাত কেবল এই কথাই ভাবি। রোজ কতবার ঠিক করি বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাব, কিন্তু যেতে পারি না, কিসে যেন আমায় জোর করে আটকে রেখেছে।

পরাশর ডাক্তার খানিকক্ষণ ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর আর কোনোদিন ছবিটা ছুয়েছো?

কতবার। দিনে ছুয়েছি, রাত্রে ছুয়েছি, আলো জ্বেলে ছুয়েছি, অন্ধকারে ছুয়েছি। ঠিক ওইরকম ব্যাপার ঘটে। দিনে বা রাত্রে আলো জ্বেলে ছুয়ে কিছু হয় না, অন্ধকারে ছোয়ামাত্র মামা আমাকে ঠেলে দেন। সমস্ত শরীর যেন ঝনঝনিয়ে ঝাকুনি দিয়ে ওঠে। কোনোদিন অজ্ঞান হয়ে যাই, কোনো দিন জ্ঞান থাকে।

বলতে বলতে নগেন যেন একেবারে ভেঙে পড়ল, ‘আমি কী করব ডাক্তার কাকা? এমন করে কদিন চলবে’?

পরাশর ডাক্তার বললেন, তার দরকার হবে না। আমি সব ঠিক করে দেব। আজ সকলে ঘুমিয়ে পড়লে রাত্রি ঠিক বারোটার সময় তুমি বাইরের ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা কোরো, আমি যাব।

একটু থেমে আবার বললেন, ভূত বলে কিছু নেই, নগেন।

তবু মাঝরাত্রে অন্ধকার লাইব্রেরিতে পরাশর ডাক্তার মৃদু একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। এ ঘরে বাড়ির লোক খুব কম আসে। ঘরের বাতাসে পুরনো কাগজের একটা ভাপসা গন্ধ পাওয়া যায়। নগেন শক্ত করে তার একটা হাত চেপে ধরে কাঁপছে। কীসের ভয়? ভূতের? তৈলচিত্রের ভূতের? ভূতে যে একেবারে বিশ্বাস করে না, যার বদ্ধমূল ধারনা এই যে যত সব অদ্ভুত অথচ সত্য ভূতের গল্প শোনা যায় তার প্রত্যেকটির সাধারণ ও স্বাভাবিক কোনো ব্যাখ্যা আছেই আছে, ছবির ভূতের।

অসম্ভব আর অবিশ্বাস্য ভূতের ঘরে পা দিয়ে তার কখনো কি ভয় হতে পারে? তবু অস্বস্তি যে বোধ হচেছ সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। নগেন যে কাহিনী শুনিয়েছে, সারাদিন ভেবেও পরাশর ডাক্তার তার কোনো সঙ্গত ব্যাখ্যা কল্পনা করতে পারেন নি। একদিন নয়, একবার নয়, ব্যাপারটা ঘটেছে অনেকবার। দিনে তৈলচিত্র নিস্তেজ হয়ে থাকে, রাত্রে তার তেজ বাড়ে। কেবল তাই নয়, অন্ধকার না হলে সে তেজ সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না। আরও একটা কথা, রাত্রি বাড়ার সঙ্গে তৈলচিত্র যেন বেশি সজীব হয়ে উঠতে থাকে। প্রথম রাত্রে নগেন অন্ধকারে স্পর্শ করলে ছবি নগেনের হাতটা শুধু ছিটকিয়ে সরিয়ে দিয়েছে, মাঝরাত্রে স্পর্শ করলে এত জোরে তাকে ধাক্কা দিয়েছে যে মেঝেতে আছড়ে পড়ে নগেনের জ্ঞান লোপ পেয়ে গেছে।

অশরীরী শক্তি কল্পনা করা ছাড়া এ সমস্তের আর কী মানে হয়?

হয়-নিশ্চয় হয়; মনে মনে নিজেকে ধমক দিয়ে পরাশর ডাক্তার নিজেকে এই কথা শুনিয়ে দিলেন। তারপর চোখ তুলে তাকালেন দেয়ালের যেখানে নগেনের মামার তৈলচিত্রটি ছিল। এঘরে তিনি আগেও কয়েকবার এসেছেন,তৈলচিত্রগুলির অবস্থান তার অজানা ছিল না। যা চোখে পড়ল পরাশর ডাক্তারের বুকটা ধড়াস করে উঠল । তৈলচিত্রগুলির দিকে দুটি উজ্জ্বল চোখ তার দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটির মধ্যে ফাক প্রায় দেড় হাত।

ঠিক এই সময় নগেন ফিসফিস করে বলল, আলোটা জ্বালব ডাক্তার কাকা?

পরাশর ডাক্তার তার গলার আওয়াজ শুনেই চমকে উঠলেন-‘না’।

রাস্তা অথবা পাশের কোনো বাড়ি থেকে সরু একটা আলোর রেখা ঘরের দেয়ালে এসে পড়েছে। তাতে অন্ধকার কমেনি, মনে হচ্ছে যেন সেই আলোটুকুতে ঘরের অন্ধকারটাই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র।

নগেন আবার ফিসফিস করে বলল, একটা কথা আপনাকে বলতে ভুলে গেছি ডাক্তার কাকা। দাদামশায় আর দিদিমার ছবি তাঁরা মরবার পর করা হয়েছিল, কিন্তু মামার ছবিটা মরবার আগে মামা নিজে শখ করে আঁকিয়েছিলেন। হয়তো সেই জন্যেই-

নগেনের শিহরন স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। ‘ভয় পেয়ে গেছেন’?

দাঁতে দাঁত লাগিয়ে পরাশর ডাক্তার তৈলচিত্রের দিকে এগিয়ে গেলেন। কাছাকাছি যেতে জ্বলজ্বলে চোখ দুটির জ্যোতি যেন অনেক কমে গেল। হাত বাড়িয়ে দিতে প্রথমে তার হাত পড়ল দেয়ালে। যত সাহস করেই এগিয়ে এসে থাকুন, প্রথমেই একেবারে নগেনের মামার গায়ে হাত দিতে তার কেমন দ্বিধা বোধ হচ্ছিল। পাশের দিকে হাত সরিয়ে তৈলচিত্রের ফ্রেম স্পর্শ করা মাত্র বৈদ্যুতিক আঘাতে যেন তার শরীরটা ঝনঝন করে উঠল। অস্ফুট গোঙানির আওয়াজ করে পিছন দিকে দু পা ছিটকে দিয়ে তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন।

১০

পরক্ষণে ভয়ে অর্ধমৃত নগেন আলোর সুইচ টিপে দিল।

মিনিট পাঁচেক পরাশর ডাক্তার চোখ বুজে বসে রইলেন, তারপর চোখ মেলে মিনিট পাঁচেক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন নগেনের মামার রূপার ফ্রেমে বাধানো তৈলচিত্রটির দিকে।

তারপর তীব্র চাপা গলায় তিনি বললেন, তুমি একটি আস্ত গর্দভ নগেন।

রাগ একটু কমলে পরাশর ডাক্তার বলতে লাগলেন, গাধাও তোমার চেয়ে বুদ্ধিমান। এত কথা বলতে পারলে আমাকে আর এই কথাটা একবার বলতে পারলে না যে তোমার মামার ছবিটা ইতোমধ্যে রূপার ফ্রেমে বাঁধানো হয়েছে আর ছবির সঙ্গে লাগিয়ে দুটো ইলেকট্রিক বাল্ব ফিট করা হয়েছে?

আমি কী জানি! ছমাস আগে যেমন দেখে গিয়েছিলাম, আমি ভেবেছিলাম ছবিটা এখানে তেমনি অবস্থাতেই আছে।

ইলেকট্রিক শক খেয়ে বুঝতে পারো না কীসে শক লাগল, তুমি কোন দেশি ছেলে? আমি তো শক খাওয়া মাত্র টের পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার মামার ছবিতে কোন প্রেতাত্মা ভর করেছেন।

নগেন উদ্‌ভ্রান্তের মতো বলল, রূপার ফ্রেমটা দাদামশায়ের ছবিতে ছিল, চুরি যাবার ভয়ে মামা অনেক দিন আগে সিন্ধুকে তুলে রেখেছিলেন। মামার শ্রাদ্ধের দিন মামিমা ফ্রেমটা বার করে মামার ছবিটা বাঁধিয়েছিলেন। আলো দুটো লাগিয়েছে আমার মামাতো ভাই পরেশ।

১১

হ্যাঁ। সে এ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাই বলল, এই সামান্য কাজের জন্য ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে পয়সা দেব কেন?

পরাশর ডাক্তার একটু হেসে বললেন, পরেশ তোমার মামার উপযুক্ত ছেলেই বটে। কিছু পয়সা বাঁচানোর জন্য বাপের ছবিতে ভূত এনে ছেড়েছে। এ খবরটা যদি আগে দিতে আমায়-

নগেন সংশয়ভরে বলল, কিন্তু ডাক্তার কাকা-

পরাশর ডাক্তার রাগ করে বললেন, কিন্তু কী? এখনো বুঝতে পারছ না। দিনের বেলা মেন সুইচ অফ করা থাকে, তাই ছবি ছুলে কিছু হয় না – ছবি মানে ছবির রূপার ফ্রেমটা। রূপার ফ্রেমটার নিচে কাঠফাট কিছু আছে, দেয়ালের সঙ্গে যোগ নেই, নইলে তোমাদের ইলেকট্রিকের বিল এমন হুহু করে বেড়ে যেত যে আবার কোম্পানির লোককে এসে লিকেজ খুঁজতে হতো। তুমিও আবার ভূতের আসল পরিচয়টা জানতে পারতে। সন্ধ্যার পর বাড়ির সমস্ত আলো জ্বলে আর বিদ্যুৎ তামার তার

দিয়ে যাতায়াত করতে বেশি ভালোবাসে কিনা, তাই সে সময় ছবি ছুলে তোমার কিছু হয় না। এ ঘরের আলোটা জ্বাললেও তাই হয়। মাঝরাত্রে বাড়ির সমস্ত আলো নিভে যায়, তখন ছবিটা ছুলে আর কোনো পথ খোলা নেই দেখে বিদ্যুৎ অগত্যা তোমার মতো বোকা হাবার শরীরটা দিয়েই-

পরাশর ডাক্তার চুপ করে গেলেন। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, সুযোগ পেলে তার শরীরটা পথ হিসেবে ব্যবহার করতেও বিদ্যুৎ দ্বিধা করে না। তিনি হাঁফ ছাড়লেন। কপাল ভালো তড়িতাহত হয়ে প্রাণে মরতে হয় নি।

তৈলচিত্রের ভূত গল্পের পাঠ পরিচিত

তৈলচিত্রের ভূত’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি কিশোর-উপযোগী ছোটগল্প। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মৌচাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এ গল্পটি। ভূত-বিশ্বাস নিয়ে মানুষের মধ্যে বিরাজমান কুসংস্কার যে ভিত্তিহীন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পে তা তুলে ধরেছেন। এ গল্পে তিনি দেখিয়েছেন বিজ্ঞানবুদ্ধির জয়। কুসংস্কারাচ্ছন্নতার কারণে মানুষ নানা অশরীরী শক্তির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে বিভ্রামত হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষকে যদি বিজ্ঞান চেতনা দিয়ে ঘটনা বিশ্লেষণে উদ্বুদ্ধ করা যায় তাহলে ঐসব বিশ্বাসের অমতঃসারশূন্যতা ধরা পড়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পে নগেন-চরিত্রের মধ্যে ভূত-বিশ্বাসের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে পরাশর ডাক্তারের মধ্যকার বিজ্ঞানসম্মত বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে স্পষ্ট করে তুলেছেন নগেনের বিশ্বাস ও কুসংস্কারের ভিত্তিহীনতাকে। মৃত ব্যক্তির আত্মা ভূতে পরিণত হয়-এরকম বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত থাকায় নগেন বৈদ্যুতিক শককে ভূতের কাজ বলে সহজে বিশ্বাস করেছে। অন্যদিকে পরাশর ডাক্তার সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করেন বলে তার কাছে বৈদ্যুতিক শকের বিষয়টি সহজেই ধরা পড়েছে।

মূলভাব -তৈলচিত্রের ভুত

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘তৈলচিত্রের ভূত’ ছােটগল্পটি অতিপ্রাকৃত ঘটনার আশ্রয়ে রচনা করেছেন। এটি কিশাের উপযােগী রচনাসমুহের অন্তর্ভূক্ত একটি ছােটগল্প। সমাজে ভূত প্রেতে বিশ্বাস নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার যে ভিত্তিহীন সেই বিষয়টি এ গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।গল্পে নগেন কলেজ পড়ুয়া কিন্তু সে ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে। সে বড়লােক মামার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করে। তবে মামার কৃপণ স্বভাবের কারনে তার প্রতি নগেনের কখনই অন্তর থেকে শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। যেটুকু ছিল তা নিতান্তই দায়ে পড়ে। অথচ মৃত্যুর আগে কী যেন ভেবে মামা তার নিজের ছেলেদের ভাগের সমান অংশের টাকা তার নামেও উইল করে গেছেন কিন্তু জীবিত অবস্থায় মামা তার সংগে যেমন ব্যবহারই করুন না কেন, মৃত্যুর পর মামার এ রকম উদারতার কথা ভেবে পরলােকগত মামার প্রতি শ্রদ্ধভক্তিতে তার মন ভরে ওঠে। সারাজীবন শ্রদ্ধাভক্তির ভান করে আমাকে সে ঠকিয়েছে।

তৈলচিত্রের ভূত’ গল্পে লেখক কুসংস্কারের বিপরীতে বিজ্ঞানবুদ্ধির জয়কে প্রকাশ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন মানুষকে যদি বিজ্ঞানচেতনা দিয়ে ঘটনা বিশেষণে উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে অন্ধবিশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতা ধার পড়ে। লেখক এ গল্পে নগেন চরিত্রের মধ্যে ভূত বিশ্বাসের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে পরাশর ডাক্তারের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক বিচার বুদ্ধি। মৃত ব্যক্তির আত্মা ভূতে পরিণত হয় এরকম বিশ্বাস সমাজে প্রচলিত থাকায় নগেন বৈদ্যুতিক শককে ভুতের কাজ বলে সহজেই বিশ্বাস করেছে। পরাশর ডাক্তার সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করেন বলে তাঁর কাছে। বৈদ্যুতিক শকের বিষয়টি ধরা পড়েছে এবং তাঁর মাধ্যমেই নগেনের বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

তৈলচিত্রের ভূত গল্পের লেখক পরিচিতি

বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় খ্যাতিমান। ১৯০৮ সালে তিনি সাঁওতাল পরগনার দুমকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃপুরুষের বসতি ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে। পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা প্রভৃতি উপন্যাস এবং প্রাগৈতিহাসিক, সরীসৃপ, সমুদ্রের স্বাদ, টিকটিকি, হলুদ পোড়া, হারানোর নাতজামাই প্রভৃতি ছোটগল্পের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। মানুষের মন বিশ্লেষণের দিকেই ছিল তাঁর ঝোক। তিনি শ্রমিক-কৃষকের কল্যাণের কথাও ভেবেছেন।

শোষণ থেকে তাদের মুক্তির জয়গান গেয়েছেন গল্প-উপন্যাসে। তিনি মাঝির ছেলে নামে একটি কিশোর-উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর কিশোর-উপযোগী গল্পের সংখ্যা ২৭। এর মধ্যে কোথায় গেল? জব্দ করার প্রতিযোগিতা, ‘তিনটি সাহসী ভীরুর গল্প’, ‘ভয় দেখানোর গল্প’, ‘সনাতনী’, ‘দাড়ির গল্প’, ‘সূর্যবাবুর ভিটামিন সমস্যা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। লেখক জীবনে তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল দারিদ্র্য। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেষ কথা

আশা করছি এই পোস্ট আপনাদের ভালোলেগেছে এবং এখান থেকে তৈলচিত্রের ভূত গল্প সংগ্রহ করতে পেরেছেন। যাদের কঠিন শব্দ গুলো বুঝতে অসুবিধা হয়েছে, তারা উপরের অংশ থেকে শব্দার্থ গুলো পড়ে নিবেন। এই রকম শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য পেতে আমার সাথেই থাকুন।

আরও দেখুনঃ

পড়ে পাওয়া-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ১ম পত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *